ঢাকা ব্যুরো থেকে ॥ আলোচিত ব্যবসায়ী ‘প্রিন্স’ মুসা বিন শমসের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে, তার পুরোটাই বিদেশে উপার্জনের দাবি করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বিষয়ে যা বলা হয়, আমি সাত বিলিয়ন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছি। কেউ কোনো দিন এত টাকা এদেশে আয় করতে পারেনি, পারবেও না। আমি এই টাকা বিদেশে উপার্জন করেছি।”
সাত গাড়ি দেহরক্ষী নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে আসেন মুসা, জাঁকজমকপূর্ণ চালচলনের কারণে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে যাকে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ বলা হয়। অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক কার্যালয়ে মুসাকে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। তিনিই বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্বে রয়েছেন। আলোচিত এই ব্যবসায়ীকে তলব করে গত ৪ ডিসেম্বর গুলশানের বাসা ও বনানীর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল দুদক।
সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা সাত বিলিয়ন ডলার (৫১ হাজার কোটি টাকা) উদ্ধার হলে দেশে ফিরিয়ে এনে দেশ গড়তে দেশের মানুষের জন্য দিয়ে দেবেন বলে জানান মুসা বিন শমসের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন। সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা ৫১ হাজার কোটি টাকা দেশে ফেরত আনা ও বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের উৎস খুঁজতে তাকে জিজ্ঞাসবাদ করতে দুদক নোটিশ দেয়। এই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল দুদক কার্যালয়ে আসেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদক থেকে বেরিয়ে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের বলেন, দুদক আমাকে ডেকেছে, আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক, সেকারণে দুদকের ডাকে আমি এসেছি। অভিযোগের তদন্ত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব গল্পেরই একটি ইতিহাস থাকে, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সত্য বেরিয়ে আসে। আমার বিষয়ে বলা হচ্ছে আমি সাত বিলিয়ন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছি। আমি এ দেশ থেকে কোনো টাকা অর্জন করিনি। বিদেশে ব্যবসা করে আমি এ সব অর্থ অর্জন করেছি। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি ব্যবসা করে আসছি। কেউ কোনো দিন এত টাকা এদেশে আয় করতে পারেনি, পারবেও না। এ টাকা পাচার করা টাকা না।
অর্থ পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করলেও সুইস ব্যাংকে টাকা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেননি মুসা বিন শমসের। এবারই প্রথম তিনি সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা টাকার বিষয়ে মুখ খুললেন। তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা ওই টাকা আমার। এ টাকা উদ্ধার করা গেলে পদ্মা সেতু, দুঃস্থ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষকসহ সামাজিক গঠনমূলক কর্মকান্ডে অবদান রাখব। সুখি-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করব।
পদ্মা সেতু নির্মাণে তিন বিলিয়ন ডলার ব্যয় তার জন্য বেশি কিছু না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু আমারই নয়, আমার পিতারও স্বপ্ন ছিল। সেতু নির্মাণে গোয়ালন্দ থেকে আরিচা, নগরবাড়ি এ্যাঙ্গেলে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। আমি অফিসিয়ালি দুদককে বলেছি, সেতু নির্মাণের বিভিন্ন খাতে আমি বিনিয়োগ করব। এদিকে জনশক্তি রফতানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের রেমিটেন্স আসে জনশক্তি রফতানি থেকে। জনশক্তি রফতানি না হলে আমাদের দেশ সোমালিয়া হয়ে যেত। দুদকের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক বুঝতে পেরেছে ‘আমি কে।’ আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আইনের প্রতি আমি শ্রদ্ধা রেখেই দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হয়েছি।”
দুদক সূত্র জানায়, বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বস এর প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ২০১১ সালে মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তবে অজ্ঞাত কারণে দুদকের এ অনুসন্ধান আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ তিন বছর পর চলতি বছরের ‘বিজনেস এশিয়া’ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে অবারও নতুন করে অনুসন্ধানে নামে দুদক। বিজনেস এশিয়া ম্যাগাজিনে মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি এই ধনাঢ্য অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাত বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকে আছে। যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ উপমহাদেশে প্রিন্স মুসা শীর্ষস্থানীয় বর্ণাঢ্য ব্যক্তি যিনি এক বিলিয়ন পাউন্ড উপার্জন করেছেন ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসা করে।
২০১১ সালে প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনে বলা হয়, মুসা বিন শমসেরই বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের ওপরে। তিনি অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিত। মুসা বিন শমসের ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে অনুদান দিতে চেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। লেবার পার্টির প্রার্থী টনি ব্লেয়ার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তার পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দুদক সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের ২৪ জুন মুসার যাবতীয় ব্যাংক হিসাব তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুদকের চাহিদার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুসার ব্যাংক হিসাব তলব করলেও রহস্যজনক কারণে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপর এবছর নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উল্লেখ্য, দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলী মুসা বিন শমসেরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।